মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)এর সন্ধি

মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)এর সন্ধির ধারা ও শর্তাবলী এখানে উল্লেক্ষ করা হচ্ছে।
১-আহলে বাইতের অনুসারীদের রক্ত সম্মানিত ও হেফাজত থাকবে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করা যাবে না।
২-মুয়াবিয়াকে হযরত আলী (আ.)র বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, গালি-গালাজ, অপবাদ ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।
৩-জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোকে এক মিলিয়ন (দশ লক্ষ) দেরহাম অর্থ সাহায্য দিতে হবে ইরানি প্রদেশগুলোর সরকারি আয় থেকে।
৪–ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলে উল্লেখ করবেন না।
৫-মুয়াবিয়া কে অনৈসলামী আচার-আচরণ পরিহার করতে হবে এবং আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে হবে।
৬-মুয়াবিয়া কোনো ব্যক্তিকেই (খেলাফতের জন্য) নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করতে পারবে না। মুয়াবিয়া মারা গেলে খেলাফত ফেরত দিতে হবে ইমাম হাসান (আ.)র কাছে।
৭-ইমাম হাসান (আ.) যদি মারা যান, তাহলে মুসলিম জাহানের খেলাফত হস্তান্তর করতে হবে রাসূল (সা.)’র ছোট নাতি হযরত ইমাম হুসাইন(আ.)’র কাছে।
কিন্তু মুয়াবিয়া প্রকাশ্যেই নির্লজ্জভাবে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করেছিল। মুয়াবিয়া ৫০ হিজরিতে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করে। ৬০ হিজরিতে মৃত্যুর কিছু দিন আগে মুয়াবিয়া তার মদ্যপ ও লম্পট ছেলে ইয়াজিদকে মুসলমানদের খলিফা বলে ঘোষণা করে।
মুয়াবিয়া বলত যেখানে টাকা দিয়ে কাজ হয় সেখানে আমি টাকা বা ঘুষ ব্যবহার করি, যেখানে চাবুক দিয়ে কাজ হয় সেখানে আমি তরবারি ব্যবহার করি না, আর যেখানে তরবারি দরকার হয় সেখানে তরবারি ব্যবহার করি। মুয়াবিয়া রাজ-কোষাগারকে ব্যবহার করত প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে আনার কাজে।
মুয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত সন্ধি-চুক্তির অপব্যবহার করেছিল। সে কুফায় প্রবেশ করে বক্তৃতার আসনে এটা বলে যে “হাসান আমাকে যোগ্য মনে করেছে, নিজেকে নয়। এ জন্য সে খেলাফত আমার কাছে ছেড়ে দিয়েছে।” ইমাম হাসান (আ.) সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ মুয়াবিয়া মিথ্যাচার করছে।“ এরপর তিনি তার যোগ্যতা ও মর্যাদার ব্যাপারে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। সেসবের মধ্যে মুবাহিলাতে তাঁর অংশ গ্রহণের কথা তুলে ধরেন। অবশেষে তিনি বলেন, “আমরা কুরআন এবং নবীর সুন্নত মতে সবার চেয়ে উত্তম এবং এ কারণেই সবার চেয়ে যোগ্যতর।”
ইমাম সন্ধির শর্তেই এটা উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলবেন না। এরই আলোকে তিনি কখনও মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়্যাত হননি এবং মুয়াবিয়ার কোন নির্দেশই মান্য করতেন না। যেমন, মুয়াবিয়া খারেজিদের বিদ্রোহ দমনে ইমামের সহায়তা চান এবং তাঁকে খারিজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমাম হাসান (আ.) তার কথায় মোটেও কর্ণপাত করেননি।
অনেকে এ প্রশ্ন করেন যে, একদল লোক তো মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল। তাহলে ইমাম হাসান (আ.) কেন যুদ্ধ করলেন না? এর উত্তর হল, সে সময় যুদ্ধ করাটা ছিল মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী, তাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দাবি যারা করেছিল তা মেনে নেওয়াকে ইমাম যৌক্তিক মনে করেননি। নবী ও ইমামরা কখনও ভুল করেন না, যদিও জনগণ অনেক সময় এই ঐশী নেতৃবৃন্দের দূরদৃষ্টিপূর্ণ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে না বরং বহু পরে বুঝতে পারে। যেমন, বিশ্বনবী (সা.)’র সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধি। যেমন, ওমর ইবনে খাত্তাব (দ্বিতীয় খলিফা) হুদায়বিয়া সন্ধির অপমানজনক (দৃশ্যত) শর্তগুলোর আলোকে এ সন্ধির সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তখন বলেছিলেন, “ আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আমি কখনও তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করি না এবং তিনি কখনও আমার কোন ক্ষতি করেন না”। আর তাই হয়েছিল। কিছু দিন পর এই শান্তি চুক্তির কল্যাণকর দিকগুলো সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, যুদ্ধের আগুন নিভে যাওয়ায় ও মক্কাতে মুসলমানদের গমনাগমনের কারণে মুশরিকরা ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ বোঝার সুযোগ পেয়েছিল এবং তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে যায়। ফলে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মক্কার অধিবাসীদের বেশিরভাগই ইসলামে দীক্ষিত হয়।
ইমাম হাসান (আ.) কে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল মুয়াবিয়া জালিম হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিজে সত্য পথে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও কেন তার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি বা সন্ধি করেছেন? ইমাম তখন হুদায়বিয়ার সন্ধির দৃষ্টান্ত দেন এবং হযরত খিজির নবীর কাজগুলোর রহস্যময় উদ্দেশ্য বুঝতে না পারার কারণে হযরত মুসা নবী (আ.)’র রাগের কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো জানান যে, মুয়াবিয়ার সঙ্গে ওই সন্ধি না করলে পৃথিবীর বুকে আহলে বাইতের কোন অনুসারী টিকে থাকত না।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনায়ী এক বিশ্লেষণে বলেছেন, “ইমাম হাসান (আ.)’র যুগে কপটতা বা মুনাফিকির মাত্রা তাঁর বাবার যুগের তুলনায় এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে ইমাম জানতেন তিনি যদি তাঁর মুষ্টিমেয় সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান তাহলে নৈতিক অধঃপতনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ততকালীন মুসলিম সমাজ তাঁর রক্তের বদলা নেয়ার কোনো চেষ্টাই করত না। বরং মুয়াবিয়ার প্রচারণা, অর্থ বা ঘুষ ও কূট-কৌশলগুলো সবাইকে এমনভাবে বশে নিয়ে আসত যে দুই-এক বছর পর লোকেরা বলবে, ইমাম হাসান (আ.) বৃথাই বা অনর্থক মুয়াবিয়ার মোকাবেলায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই ইমাম সব ধরনের কষ্ট নিজের জন্য ডেকে এনে সেসব সহ্য করলেন, কিন্তু তবুও শাহাদতের পথ ধরেননি; কারণ, তিনি জানতেন যে তার শাহাদত বৃথাই যেত।“
ইমাম যে অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তার সাক্ষ্য বহু আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা.)। তিনি বলেছিলেন, “বুদ্ধিমত্তা যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সে হল হাসান বিন আলী।“
মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের সঙ্গে সন্ধির পর যখন সব কিছুর উপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তখন সে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করবে বলে জানিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া ইমামকে মদীনায় সব ধরনের কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং মদীনায় নিয়োজিত তার গভর্নররাও একই কাজে মশগুল ছিল। ফলে ইমাম মদীনায় দশ বছর অবস্থান করা সত্ত্বেও তার অনুসারীরা এই মহান ইমামের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ খুবই কম পেত। ফলে ইমাম হাসান (আ.)’র মত মহাজ্ঞানের উৎস থেকে খুব কম সংখ্যক অনুসারীই উপকৃত হতে পেরেছে। এই মহান ইমাম থেকে বর্ণনার সংখ্যাও তাই খুব কম দেখা যায়।
মুয়াবিয়া নিজের মৃত্যু আসন্ন এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজের ছেলের জন্য ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার আয়োজন করতে থাকে। সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, ইমাম হাসান (আ.) বেঁচে থাকলে জনগণ সহজেই তার লম্পট ছেলেকে খলিফা হতে দেবে না। তাই মুয়াবিয়া বেশ কয়েকবার ইমামকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অবশেষ চক্রান্তের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমামকে শহীদ করে। পঞ্চদশ হিজরির সফর মাসের ২৮ তারিখে ৪৮ বছর বয়সে শাহাদতের অমৃত পান করেন ইমাম হাসান (আ.)। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

Reviews

98 %

User Score

2 ratings
Rate This

Sharing

Leave your comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।