ইমাম হাসান (আ.)এর সাথে মুয়াবিয়ার সন্ধির নামে ষড়যন্ত্র

৩য় হিজরির ১৫ই রমজান ইসলামের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন। কারণ, এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ও অন্যতম প্রিয় নাতি হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)। তিনি ছিলেন আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (সা.)’র প্রথম সন্তান এবং সে যুগের সব মু’মিন মুসলমানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রিয় শিশু।
বিশ্বনবী (সা.) ওফাতের পর থেকে ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর পিতার অনুসারী এবং পিতার মতই মজলুমদের সমর্থন দিতেন। তিনি জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে পিতার পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন এবং অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জামাল যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য তিনি পিতার নির্দেশে নবীজির সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে সঙ্গে নিয়ে কুফায় গিয়ে সেখানকার জনগণকে পিতার পক্ষে সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে বসরায় নিয়ে এসেছিলেন।
আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.) নিজের ইন্তিকালের সময় ইমাম হাসান (আ.)-কে তাঁর খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। বিশ্বনবী (সা.)ই তা করার জন্য ইমাম আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের জীবদ্দশায়।
ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)’র ক্ষমাশীলতা, পরোপোকারিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা শত্রুদেরও মুগ্ধ করত। মারওয়ান হাকাম এই মহান ইমামকে সব ধরনের কষ্ট দিয়েছে ও বিরক্ত করেছিল।
ইমাম হাসান (আ.) খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তা মেনে নেয়নি। আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রের যে ধারা মুয়াবিয়া সূচিত করেছিল এই ইমামের বিরুদ্ধেও সেই একই ধারা অব্যাহত রাখে। ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে তাকে সুপথে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চিঠির একাংশে তিনি লিখেছিলেন, “তুমিও অন্যদের মতই আমার হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ কর। তুমি নিজেই ভাল করে জান যে আমি তোমার চেয়ে বেশি যোগ্যতার অধিকারী। আল্লাহকে ভয় কর এবং অত্যাচারী জালিমদের মধ্যে গণ্য হয়ো না।”
মুয়াবিয়া যদি এখনও ভুল করে (অর্থাত বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে) তাহলে ইমাম হাসান (আ.) মুসলমানদেরকে নিয়ে তাকে শাস্তি দেবেন বলেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন ওই চিঠিতে। তিনি তাকে এও লিখেছিলেন যে, “আল্লাহকে ভয় কর, জুলুম ও মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ কর। অনুগত ও শান্তিকামী হও। আর এমন লোকদের সঙ্গে কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ করো না যারা তোমার চেয়ে এ কাজে বেশি যোগ্য।”
কিন্তু মুয়াবিয়া চিঠির উত্তরে নিজেকে বেশি অভিজ্ঞ বলে দাবি করে। অবশ্য সে প্রলোভন দেখানোর জন্য বলে যে, ইমাম হাসান (আ.) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে পরবর্তী খলিফা ইমামকেই করা হবে।
মুয়াবিয়া এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। সে ইমামকে গোপনে হত্যার জন্য কিছু লোককে নিয়োজিত করে। খলিফা হিসেবে ইমাম হাসান (আ.)-কে মেনে না নেয়ার কারণ হিসেবে ইমামের বয়সের স্বল্পতার অজুহাত দেখানো সত্ত্বেও মুয়াবিয়া নিজের তরুণ সন্তান ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করে। এছাড়াও মুয়াবিয়া ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য লোকজন জড় করে তাদেরকে ইরাকে পাঠায়।
এ অবস্থায় ইমামও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন এবং ইমামের কয়েকজন অনুসারী যুদ্ধের জন্য জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনগণের এক বিশাল অংশকে যুদ্ধের জন্য সংঘবদ্ধ করেন। কিন্তু এদের মধ্যে একদল ছিল খারেজি। এরা মুয়াবিয়ার বিরোধী হলেও ইমামের অনুগত ছিল না। আর একদল এসেছিল কেবল গণিমতের লোভে। আর একদল ছিল গোত্রবাদের কারণে গোত্রীয় সর্দারদের নির্দেশে যুদ্ধ করতে আসা ব্যক্তি। এদের কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। আর অতি অল্প কয়েক জন ছিল ইমামের খাঁটি সমর্থক।
ইমাম হাসান (আ.) তাঁর বাহিনীর একাংশকে পাঠান আনবার শহরে হাকামের সেনাপতিত্বে। হাকাম মুয়াবিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে বসে। পরবর্তী সেনাপতির অবস্থাও হয়েছিল একই রকম। ইমাম নিজে মাদায়েনের সাবাত্ব এলাকায় গিয়ে সেখান থেকে বারো হাজার সেনাকে ওবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসের সেনাপতিত্বে মুয়াবিয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য পাঠান। আর কেইস বিন সা’দ বিন ইবাদাহকে উপ-সেনাপতি করেন যেন ওবায়দুল্লাহর অনুপস্থিতিতে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
এদিকে মুয়াবিয়া কেইসকে ধোঁকা দেয়ার ফন্দি করে। সে তার সঙ্গে সহযোগিতা অথবা অন্ততঃ ইমামের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য কেইসের কাছে এক মিলিয়ন দেরহাম পাঠায়। কেইস জবাবে বলে: “প্রতারণার মাধ্যমে তুমি আমার ধর্মকে কেড়ে নিতে পারবে না।” কিন্তু প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কেবল সেই অর্থেই প্রতারিত হয় এবং রাতের অন্ধকারে তার একদল একনিষ্ঠ অনুসারী নিয়ে মুয়াবিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। কেইস এই ঘটনা ইমাম হাসান (আ.)-কে জানান এবং বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এ অবস্থায় মুয়াবিয়া ইমামের সেনাবাহিনীতে গুপ্তচর পাঠিয়ে মুয়াবিয়ার সঙ্গে কেইসের সন্ধি হওয়ার বানোয়াট সংবাদ প্রচার করতে থাকে। আর মুয়াবিয়ার আরেক দল গোয়েন্দা কেইসের সেনাবাহিনীতে ঢুকে এ কথা প্রচার করতে থাকে যে ইমাম হাসান (আ.) নিজেই মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করেছেন। এভাবে খারেজি ও সন্ধি-বিরোধীরা প্রতারিত হয়। তারা বিদ্রোহ করে ও হঠাত ইমামের তাবুতে হামলা চালায় ও লুট-তরাজ করে। এমনকি ইমামের বিছানা পর্যন্ত লুট করে এবং ইমামের উরুতে তলোয়ার দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানে। ফলে তিনি শোচনীয়ভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ইমামের সঙ্গীরা তাঁকে মাদায়েনের গভর্নরের বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন তাঁর চিকিতসা চলে।
এ সময় ইমাম হাসান (আ.) জানতে পারেন যে অনেক গোত্র-প্রধান বা সর্দার তাঁকে মুয়াবিয়ার কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত কাছে গোপনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মুয়াবিয়া হুবহু তাদের চিঠিগুলো ইমামের কাছে পাঠিয়ে সন্ধির অনুরোধ করে এবং বলে যে এই সন্ধিপত্রে ইমাম যেই শর্তই দেন না কেন, তা-ই মেনে নেয়া হবে।
এ অবস্থায় ইমাম হাসান (আ.) যখন একদিকে অসুস্থ ও তাঁর অনুসারীরা নানা দিকে বিক্ষিপ্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে পথ ও মতের মিল ছিল না তখন যুদ্ধ অব্যাহত রাখা আর ইসলামের স্বার্থের অনুকূল রইল না। কারণ, মুয়াবিয়া যুদ্ধে জয়ী হলে ইসলামের মূলোতপাটন করে ছাড়ত। তাই ইমাম বেশ কিছু কঠিন শর্ত দিয়ে সন্ধি-চুক্তি তথা যুদ্ধ-বিরতি করতে সম্মত হলেন।
উল্লেখ্য, বিদ্রোহী মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে উতসাহিত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই যোদ্ধাদের বেতন শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাই এ ধারণা ঠিক নয় যে ইমাম হাসান (আ.) সাহসী ও জিহাদপন্থী ছিলেন না। মিথ্যা প্রচারে অভ্যস্ত উমাইয়ারাই ইমামকে ভীরু ও বিলাসী হিসেবে ইতিহাসে তুলে ধরতে চেয়েছে। তিনি যদি জিহাদকে ভয় পেতেন তাহলে বাবার সঙ্গে জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে অংশ নিতেন না।
এ ছাড়াও হাসান (আ.) জানতেন যে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই সুযোগে বাইজান্টাইন সম্রাট ‘চতুর্থ কনস্তানতিন’ মুসলমানদের প্রথম কিবলা অধ্যুষিত বায়তুল মোকাদ্দাস শহরটি দখলের পদক্ষেপ নেবে। তাই ইমাম শান্তি ও কূটনৈতিক পন্থার মাধ্যমে প্রিয় নানার ধর্মের বার্তা তথা খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার জন্য ও ইসলামকে দূষণমুক্ত করার যে কাজ পিতা হযরত আলী (আ.) শুরু করেছিলেন সেই মিশনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলত সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা ও আদর্শিক বিচ্যুতির কারণেই ইমাম হাসান (আ.)-কে যুদ্ধ-বিরতির পথ বেছে নিতে হয়েছিল।
ইমাম (আ.) এও জানতেন যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা বা শাসন-ক্ষমতা হাতে না পেলেও মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামই থেকে যাবেন। তাই মুয়াবিয়ার স্বরূপ বা আসল চেহারা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য তাকে কিছু (নোংরা কাজের সুযোগ) অবকাশ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে এ সন্ধির ফলে মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।
অবশ্য ইমাম হাসান (আ.) ছোট ভাই ইমাম হুসাইন (আ.)’র মতই জালেম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের পথই ধরতেন যদি তিনি দেখতেন যে, অল্প কিছু সংখ্যক হলেও তাঁর কিছু একনিষ্ঠ ও নিবেদিত-প্রাণ সমর্থক রয়েছেন যারা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে ও শহীদ হতে প্রস্তুত। ইতিহাসে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন (বা কিছু কম/বেশি) শাহাদত-পাগল ও আহলে-বাইত প্রেমিক মুসলমান ইমাম হুসাইন (আ.)’র সঙ্গে স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন এবং মহাবীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। ইমাম হুসাইন (আ.) কুফার প্রায় সব মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন প্রথম দিকে। তারা পরবর্তীতে এই ইমামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। অন্যদিকে ইমাম হাসান (আ.)র সঙ্গীরা প্রথম দিকেই তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং এমনকি গোপনে শত্রু -শিবিরে যোগ দেয়। তাই ইমাম হাসান (আ.)র নিবেদিত-প্রাণ সমর্থকের সংখ্যা ছিল ইমাম হুসাইন (আ.)র নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গীদের সংখ্যার চেয়েও অনেক কম বা হাতে গোনা যে কয়জন সঙ্গী ছিল তাদের ওপর ভরসা করতে পারেননি বড় ভাই ইমাম হাসান (আ.)। কারণ, আদর্শিক দৃঢ়তা তাদের মধ্যে ছিল না।
উল্লেখ্য, মুয়াবিয়ার বাবা আবু সুফিয়ান ছিল ইসলামের ও বিশ্বনবী (সা.)র কঠোরতম শত্রু। মক্কা বিজয়ের পর (অষ্টম হিজরিতে) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর সঙ্গে তার শত্রুতা অব্যাহত থাকে। হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে এক মিথ্যা অজুহাতে সে সিরিয়া থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এই বিদ্রোহের কারণে। এই যুদ্ধে মুয়াবিয়ার পক্ষে ৪৫ হাজার নিহত এবং হযরত আলী (আ.)’র পক্ষে শহীদ হন পঁচিশ হাজার মুজাহিদ।
হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বিদ্রোহ শুরু করার পেছনে মুয়াবিয়ার অজুহাত ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডের বিচার। এটা যে নিছক অজুহাতই ছিল তার প্রমাণ হল হযরত আলী (আ.)’র শাহাদতের পর মুসলিম বিশ্বের সব অঞ্চল ছলে বলে কৌশলে করায়ত্ত করা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া আর কখনও তৃতীয় খলিফার হত্যাকারীদের বিচারের কথা মুখেও উচ্চারণ করেনি। দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল থেকেই সিরিয়ায় প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রধানের মত চালচলনে অভ্যস্ত মুয়াবিয়া জানত যে হযরত আলী (আ.)’র মত কঠোর ন্যায়-বিচারক শাসক তাকে কখনও ছোট বা বড় কোন পদ দেবেন না। তাই আলী (আ.) খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মত মুয়াবিয়াকেও পদচ্যুত করলে ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্র প্রবর্তনকারী মুয়াবিয়া সিরিয়ায় বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে।

Reviews

0 %

User Score

0 ratings
Rate This

Sharing

Leave your comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।