নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত, যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে। ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটুকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই। ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমসামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক ‘কাগজ কলম আনার ঘটনা’ খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে। এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবর্গ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না। বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে। তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ, ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন, পুরস্কৃত হবেন। আর যদি ভুল করেন, ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন)। এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায়। কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়ীতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন। খালিদ বিন ওয়ালিদ তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। কিন্তু, সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন। এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি, খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন। একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়-স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন। রাসুল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত। হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র ‘খোলাফায়ে রাশেদীনের’ যুগে অব্যাহত ছিল। আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ ৯৯ – ১০২ হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ ১৩ – ২৫ হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধন করেন। যেমনঃ ‘হজ্জে তামাত্তু’ ‘মুতাহ্ বিবাহ্ এবং আযান’ এ ‘হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল’ বাক্যটির ব্যবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনিই একই বৈঠাকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অনেক নীতির প্রচলন শুরু করেন।
দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্ব প্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যের সৃষ্টি করেন। এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের ‘কাসরা’ (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন। তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর হিজরী ২৩ সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে ৬ সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা র্নিবাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন। তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়াদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন। হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পণ করেন। এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার, দূর্নীতি, ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার প্রচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায়। তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চর্তুদিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌঁছতে লাগল। কিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না।
শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন। অবশেষে হিজরী ৩৫ সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক’দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে। সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয়। ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন। প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা। তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। দ্বিতীয় খলিফা, প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন। আর তৃতীয় খলিফা, দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদশ্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন। ঐ কমিটির র্নিবাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা র্নিধারিত হয়েছিল। যাই হোক, ইসলামের প্রথম তিন খলিফা, যাদের শাসনকাল প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে, তারা নিজস্ব ‘ইজতিহাদ’(গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন। ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে, পবিত্র কুরআন, তাফসির (ব্যাখ্যা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে। আর রাসুল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শ্রবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হিজরী ১২ সনে সংঘটিত ‘ইয়ামামা’র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল। ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের ক্বারী ও হাফেজ ছিলেন। তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর, প্রথম খলিফা আবুবকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন, ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন, তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে না। সুতরাং কুরআনের সব আয়াত গুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়। অথচ রাসুল (সা.)-এর হাদীস, কুরআনের পরই যার অবস্থান, তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল। কারণ, রাসুল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরির্বতন, পরির্বধন সংকোচন, বিস্মৃতি, বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত, সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত। পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালো যে, খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায, রোযা…. ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল। একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ, পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদীসে, জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা, অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, খেলাফতের যুগে এসে তা সস্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে। অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল। আর তখন তাদের যুদ্ধলব্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল। যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি। ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তাঁর ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে, হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি। এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে তাঁর নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন। অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে, রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন। আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একত্রিত ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন। খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশ্বাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্তক হতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান। এই দীর্ঘ ২৫ বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন। যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরত মিকদাদ (রা.)। কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব), ইয়ামান, ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসুলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন। যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চর্তুদিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয়। সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন।
টিকাসমুহ :
১.মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন ঃ “পবিত্র কুরআন একটি সম্মানিত গ্রন্থ, যার সামনে ও পিছন থেকে কখনই মিথ্যা অনুপ্রবেশ করতে পারবে না।”। -সুরা ফুসসিলাত, ৪১ও ৪২ নং আয়াত।
মহান আল্লাহ্ আরও বলেছেনঃ “একমাত্র ব্যতীত নির্দেশ দেয়ার অধিকার আর কারও নেই ”। -সুরা আল ইউসুফ, ৬৭ নং আয়াত। শরীয়ত বা ইসলামী বিধি বিধানের একমাত্র প্রতিভু আল−াহ্ই, যা নবীর মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেনঃ “বরং তিনি আল্লাহ্ রাসুল এবং সর্বশেষ নবী”। -সুরা আল আহযাব, ৪০ নং আয়াত। এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ নবুয়ত ও শরীয়তের (খোদায়ী বিধান) সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন ।
মহান আল্লাহ্ আরও বলেন ঃ “যারা আল্লাহ্ অবতীর্ণ বিধান অনুসারে নির্দেশনা প্রদান করে না, তারাই কাফের” -সুরা আল মায়েদা, ৪৪ নং আয়াত।
২. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১০ নং পৃষ্ঠা। তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৫৮ নং পৃষ্ঠা।
৩.দুররূল মানসুর, ৩য় খন্ড, ১৮৬ নং পৃষ্ঠা। তারীখে ইয়াকুবী, ৩য় খন্ড ৪৮ নং পৃষ্ঠা। এ ছাড়া পবিত্র কুওআনেও আবশ্যকীয় বিধান সুস্পষ্ট। যেমনঃ খুমস সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ঃ “জেনে রাখ! যা কিছু তোমরা লাভ কর তা থেকে এক পঞ্চামাংশ আল্লাহ্ , রাসুলের ও রাসুলের আত্মীয় স্বজনের প্রাপ্য”। (-সুরা আল্ আনফাল, ৪১ নং আয়াত।)
৪. প্রথম খলিফা আবু বকর তার খেলাফত কালে প্রায় পাঁচ শত হাদীস সংগ্রহ করেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা বর্ণনা করেনঃ “এক দিন ভোর পর্যন্ত সারা রাত আমার পিতাকে মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে দেখেছি। সকালে তিনি আমাকে বললেনঃ “রাসুল (সঃ)-এর হাদীসগুলো নিয়ে এসো। অতঃপর তিনি আনীত ঐ হাদীসগুলো পুড়িয়ে ফেলেন”। (কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা। ) দ্বিতীয় খলিফা ওমর প্রতিটি শহরে লিখিতভাবে এই মর্মে নির্দেশনামা পাঠান যে, যার কাছেই রাসুল (সঃ)-এর হাদীস রয়েছে সে যেন অতি সত্তর তা পুড়িয়ে ফেলে। (-কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা।) মুহাম্মদ বিন আবু বকর বলেনঃ “দ্বিতীয় খলিফা ওমরের যুগে রাসুল (সঃ)-এর অসংখ্য হাদীস সংগৃহীত হয়েছিল। ঐগুলো যখন তার কাছে আনা হল তখন তিনি ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন”। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৫ম খন্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা।)
৫.তারীখে ইবনে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৫১ পৃষ্ঠা, ও অন্যান্য গ্রন্থ সমূহ।’
৬. মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বিদায় হজের সময় যেসব হাজীরা দূর-দূরান্ত থেকে মক্কায় প্রবেশ করত, তাদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন । যার উৎস ছিল পবিত্র কুরআনের এই আয়াত. ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরাহ্ একত্রে একইসাথে পালন করতে চাও …..’(-সুরা আল্ বাকারা -১৯৬ নং আয়াত।) কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা তার খেলাফতের যুগে দূর থেকে আগত হাজীদের জন্যে হজ্জের ঐ আইনটি (হজ্জে তামাত্তু) বাতিল ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। ‘মোতাহ্ বা সাময়িক বিবাহ্’ যা আল্লাহ্ রাসুল (সঃ)-এর যুগে প্রচালিত ছিল, তাও দ্বিতীয় খলিফা ওমর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর তিনি তার নির্দেশ অমান্যকারীদের পাথর মেরে হত্যার বিধান জারী করেন। একইভাবে হযরত রাসুল (সঃ)-এর যুগে, ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ অর্থাৎ “উত্তম কাজের (নামাজের) দিকে ধাবিত হও” বাক্যটি আযানের মধ্যে উচ্চারিত হত । কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে বলেন ঃ এ বাক্যটি জনগণকে জিহাদে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারে! তাই তিনি তার খেলাফতের যুগে আযানে ঐ বাক্যটি উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। হযরত রাসুলের (সা.) যুগে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র এক বৈঠকে একটির বেশী ‘তালাক’ প্রদান বৈধ বলে গৃহীত হত না। কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে একই বৈঠকে তিনটি ‘তালাক’ প্রদান জায়েয বলে ঘোষণা দেন!! একই বৈঠকে তিন তালাক গৃহীত হওয়ার বৈধতা তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন। উল্লেখিত বিষয়গুলো, হাদীস গ্রন্থ ও শীয়া এবং সুন্নী মাযহাবের ফেকহ্ ও ‘কালাম’ শাস্ত্রের গ্রন্থে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
৭.তারীখে ইয়াকুবী ২য় খন্ড, ১৩১ নং পৃষ্ঠা। তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা।
৮. আসাদুল গাবা, ৪র্থ খন্ড, ৩৮৬ নং পৃষ্ঠা। আল-ইসাবাহ, ৩য় খন্ড দ্রষ্টব্য।
৯. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠা। তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৬৮ নং পৃষ্ঠা। তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা।
১০. তারীখু ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠা। তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৯৮ নং পৃষ্ঠা।
১১. মিসরবাসীদের একটি দল তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। খলিফা এতে বিপদের আশংকা করলেন। তিনি এ ব্যাপারে হযরত আলী (আঃ)-এর সহযোগিতা প্রার্থনা করেন এবং কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচণা প্রকাশ করেন। তখন হযরত আলী (আঃ) মিসরবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ “তোমরাতো সত্যের বিজয়ের জন্যেই বিদ্রোহ করেছ। আর ওসমানও তার কুর্কমের জন্য অনুতপ্ত এবং তওবা করেছেন। তিনি বলেছেন ঃ ‘আমি আমার অতীত কৃতর্কম থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছি। আগামী তিন দিনের মধ্যেই তোমাদের দাবী-দাওয়া আমি বাস্তবায়ন করব এবং সকল অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করব’। এর পর হযরত আলী (আঃ) তৃতীয় খলিফা ওসমানের পক্ষ হয়ে একটি সন্ধিপত্র প্রস্তুত করেন। অতঃপর বিদ্রোহীরা নিজ নিজ স্থানে ফিরে যায় । কিন্তু বিদ্রোহীরা বাড়ী ফেরার
পথে তৃতীয় খলিফা ওসমানের জনৈক ক্রীতদাসকে তাঁরই উটে চড়ে মিশরের দিকে যেতে দেখল। বিদ্রোহীরা সন্দিহান হয়ে ঐ ক্রীতদাসকে থামিয়ে তল্লাশী চালায়। ঘটনাক্রমে ঐ ক্রীতদাসের কাছে মিশরের প্রশাসককে লেখা তৃতীয় খলিফা ওসমানের একটি চিঠি তারা উদ্ধার করে। ঐ চিঠিতে এ ভাবেই লেখা ছিলঃ “আল্লাহ্ নামে শুরু করছি। যখন আব্দুর রহমান বিন উদাইস্ তোমার নিকট পৌঁছবে, তাকে ১০০টি চাবুক মারবে। তার চুল ও দাড়ি কামিয়ে ফেলবে এবং সুদীর্ঘ কারাবাসে নিবদ্ধ করবে। আর ওমর বিন আল- হামাক, সুদান বিন হামরান, এবং ‘উরওয়া বিন নাবা’র ব্যাপারেও একই নির্দেশ জারী করবে।” বিদ্রোহীরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত অবস্থায় ঐ চিঠি সহ ওসমানের কাছে ফিরে এসে বললঃ ‘আপনি আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন”। কিন্তু ওসমান ঐ চিঠির বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। জবাবে বিদ্রোহীরা বললোঃ “আপনার ক্রীতদাসই এই চিঠিটার বাহক”। ওসমান বললেনঃ “সে আমার বিনা অনুমতিতে এ কাজ করেছে”! তারা বললঃ “সে আপনার উটেই চড়ে যাচ্ছিল”। তিনি বললেনঃ ‘সে আমার উট চুরি করে’! তারা বললোঃ ‘চিঠিতো আপনার ব্যক্তিগত সেক্রেটারীর লেখা’। তিনি বললেনঃ ‘সে আমাকে অবহিত না করেই এ কাজ করেছে’! তারা বললো ঃ ‘তাহলে তো খেলাফতের কাজ পরিচালনা করার মত যোগ্যতা আদৌ আপনার নেই। শিগ্গীর ইস্তফা দিন। কারণ যদি প্রকৃতপক্ষে এ কাজ আপনার দ্বারাই ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই খিয়ানত করেছেন। আর যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার বিনা অনুমতিতে হয়ে থাকে তবে খেলাফতের ব্যাপারে আপনার অযোগ্যতা ও ব্যর্থতাই প্রমাণিত হল। সুতরাং ইস্তফা দিন, তা’নাহলে অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করুন”। এর উত্তরে ওসমান বললেনঃ ‘আমাকে যদি তোমাদের কথা মেনে চলতে হয়, তাহলে তো তোমরাই আমার শাসনকর্তা। সেখানে আমি কোন জন? তৃতীয় খলিফার এধরণের উত্তরে বিদ্রোহীরা চরমভাবে রাগান্বিত হয়ে ওঠে এবং বৈঠক ত্যাগ করে”। (তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড ৪০২- ৪০৯ নং পৃষ্ঠা। তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড ১৫০- ১৫১ নং পৃষ্ঠা।)
১২.তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা।
১৩. সহীহ্ বুখারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৮৯ নং পৃষ্ঠা। তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১৩ নং পৃষ্ঠা।
১৪. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১১ নং পৃষ্ঠা। তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ১২৯-১৩২ নং পৃষ্ঠা।
১৫.তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড ১১৩ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ৯ নং পৃষ্ঠা। ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, প্রথম খলিফা আবুবকর খেলাফতের ‘বাইয়াত’ প্রাপ্তির পর পরই হযরত আলী (আঃ)-এর নিকট থেকে তাঁর ‘বাইয়াত’ প্রাপ্তির জন্য লোক পাঠান। কিন্তু হযরত আলী (আঃ) উত্তর দিলেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, কেবল মাত্র নামায ছাড়া আর অন্য কোন কারণে বাড়ীর বাইরে যাব না, যাতে করে আমি কুরআন সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে পারি”। ইতিহাসে আরও পাওয়া যায় যে, রাসুল (সঃ)-এর মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পর তিনি আবু বকরের ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করেন।
এ ঘটনাটি কুরআন সংগ্রহের কাজ সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রমাণ স্বরূপ। অতঃপর হযরত আলী (আঃ) নিজ সংগৃহীত কুরআনকে উটের পিঠে করে জনগণের নিকট নিয়ে তাদেরকে দেখান। অথচ ‘ইয়মামার’ যুদ্ধের পর যখন কুরআন সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয় সেটা ছিল প্রথম খলিফা আবু বকরের খেলাফতের দ্বিতীয় বছর। এ সমস্ত ঘটনা ইসলামের ইতিহাস সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে।

Reviews

100 %

User Score

1 ratings
Rate This

Sharing

Leave your comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।