১০ বছর ইরানী বন্দরের পরিচালনভার পেলে, ভারতের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারি হবে!

ইরানের চাবাহার বন্দর নিয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন ভারতের জাহাজ ও বন্দরমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল
ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর আগামী ১০ বছরের জন্য ভারতের হাতে এল। সোমবার ইরানে গিয়ে চাবাহার বন্দর নিয়ে ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জাহাজ ও বন্দরমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে ভারত এই প্রথম কোনও বিদেশি সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করার সুযোগ পেল।
২০১৫ থেকে চাবাহারের শহিদ বেহেশ্তি বন্দর ব্যবহারের জন্য প্রতি বছর ভারত-ইরানের চুক্তি নবীকরণ হচ্ছিল। নতুন চুক্তির ফলে টানা ১০ বছর বন্দরের পরিচালনভার পেল ভারত, যা মেয়াদ পার হলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে নবীকরণ হবে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে চাবাহার সমুদ্রবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাবাহারের নিকটতম বন্দর গুজরাতের কান্দালা। দূরত্ব ৫৫০ নটিক্যাল মাইল। মুম্বইয়ের দূরত্ব ৭৮৬ নটিক্যাল মাইল। ভারত, পশ্চিম এশিয়া, ইউরেশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং পরিবহণ খরচ ও সময় কমানোর ক্ষেত্রে প্রাণকেন্দ্র হতে পারে এই সমুদ্রবন্দর।
চাবাহারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ায় আফগানিস্তান, ইরান হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত জলপথ পরিবহণে আধিপত্য কায়েম করতে পারবে ভারত। পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান এবং পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছতে বিকল্প রাস্তা হিসাবে কাজে লাগাতে পারবে এই বন্দরকে।
ভারত এই সমুদ্রবন্দর হাতে পাওয়ার পর চাপে পড়েছে আমেরিকা। ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করায় ভারতের বিরুদ্ধে কি আমেরিকা কোনও ব্যবস্থা নেবে? এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে। যদিও হোয়াইট হাউস এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও সরকারি বিবৃতি জারি করেনি।
তবে ভারতের উপর তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, তেমন এক ইঙ্গিত দিয়েছে আমেরিকা। ভারত-ইরান চুক্তি প্রসঙ্গে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র বেদন্ত পটেল হুঁশিয়ারির সুরে বলেন, ‘‘কেউ যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ভাবে, তা হলে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।’’
ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক যে ভাল নয়, তা সকলেই জানে। বিভিন্ন ইস্যুতে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে হোয়াইট হাউস। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারি করার তালিকায় ইরান রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। প্রথমে রাশিয়া।
সম্প্রতি ইজ়রায়েলের দিকে ৩৫০-এর বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এই হামলার পর ইরানের সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ দিকে, ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধই হোক বা ইরান-ইজ়রায়েল কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন— ভারত সব সময়ই নিরপেক্ষ থেকেছে। যুদ্ধ বা হামলার সমালোচনা করলেও নয়াদিল্লি কখনও কারও পক্ষ নেয়নি। সে দিক থেকে আমেরিকা সব ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও পক্ষ অবলম্বন করেছে।
চাবাহার বন্দরকে কেন্দ্র করে কি ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে চিড় ধরবে? ভারতের উপর কি সত্যিই নিষেধাজ্ঞা চাপাবে হোয়াইট হাউস? এই সব প্রশ্নই এখন ঘুরছে বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে। অনেকের মতে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হঁশিয়ারি ‘ফাঁকা’আওয়াজ ছাড়া কিছুই নয়।
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন অনেক নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ভারতকে। করোনার ওষুধ হোক বা রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় কিংবা চাবাহার বন্দর— একাধিক বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চড়া সুর শোনা গিয়েছে ট্রাম্পের গলায়। কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা জারির হুঁশিয়ারিও দিতেন তিনি।
কিন্তু আদৌ আমেরিকা কোনও নিষেধাজ্ঞা চাপায়নি ভারতের উপর। চাবাহার বন্দর নিয়েও কি আমেরিকা ‘ফাঁকা’আওয়াজ দিচ্ছে? আমেরিকার সঙ্গে ভারত এক মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সেই সম্পর্ক ভেঙে হোয়াইট হাউস কোনও কড়া পদক্ষেপ করতে চায়নি।
চাবাহার বন্দর নিয়ে চুক্তির কারণে আমেরিকা ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না, এমনই মনে করছেন ইরানের রাষ্ট্রদূত ইরাজ ইলাহি। কেন এমন কথা বলছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, তাদের উপেক্ষা করতে পারবেনা আমেরিকা।’’
ইলাহি আরও বলেন, ‘‘চাবাহার বন্দর ভারত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে মানে এই নয় যে, এই সমুদ্রবন্দর শুধুমাত্র ভারতই ব্যবহার করবে। ভারত চাইলে ভবিষ্যতে এই বন্দর ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, রাশিয়া-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ ব্যবহার করতে পারবে।’’
আমেরিকা যদি চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে তা আমেরিকার বিপক্ষে যেতে পারে বলে মনে করছেন ইরানের রাষ্ট্রদূত। তাঁর মতে, নিষেধাজ্ঞা জারি হলে শুধু আমেরিকার উপর ভারত অখুশি হবে তা নয়। পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার অনেক দেশই অখুশি হবে।
মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ অনেকটাই নির্ভর করে এই চাবাহার বন্দরের উপর। কারণ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানকে এড়িয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গেলে চাবাহার বন্দরই ভরসা মধ্য এশিয়ার দেশগুলির।
ইলাহি মনে করেন, হোয়াইট হাউস যদি ভারতের উপর এই চুক্তি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের রোষের মুখে পড়তে পারে তারা। এমনকি বাণিজ্যিক সম্পর্কও নষ্ট হতে পারে। তাই ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঝুঁকি থেকে বিরতই থাকবে আমেরিকা।
শুধু তা-ই নয়, ঠান্ডা লড়াইয়ের পর বিশ্বে আমেরিকার যে ‘দাদাগিরি’ ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই খর্ব হয়েছে বলে মনে করে ভারত। একটা সময় এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, যেখানে আমেরিকাই ছিল শেষ কথা। ক্ষমতার ফয়দা তুলে আমেরিকা বিশ্বের বহু দেশের উপর নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি বিষয়ে আমেরিকা কোনও কড়া পদক্ষেপ করতে পারবে না বলেই মত বিশ্বে কূটনৈতিক মহলের একাংশের। আমেরিকার হুঁশিয়ারি সম্পর্কে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দরকার। এটা বোঝাতে হবে যে এই চাবাহার বন্দর প্রকল্পে সবার মঙ্গল হবে।’’
জয়শঙ্কর আরও দাবি করেন, আমেরিকা চাবাহার বন্দর প্রকল্পকে নেতিবাচক ভাবে দেখছে না। তাঁর কথায়, ‘‘চাবাহার প্রকল্পের সার্বিক ভাবে প্রশংসা করেছে আমেরিকা।’’তবে হোয়াইট হাউস সরকারি ভাবে কী বিবৃতি দেয় বা পদক্ষেপ করে, সে দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব।

Reviews

0 %

User Score

0 ratings
Rate This

Sharing

Leave your comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।