হযরত ইমাম রেজার (আ.)এর শাহাদাত
ইসলামি কেলেন্ডার অনুযায়ী ২০৩ হিজরির ত্রিশে সফর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)এর শাহাদাত-বার্ষিকী।
ইমাম রেজা (আ.) পবিত্র মদিনায় ইমাম মুসা ইবনে জাফর আস সাদিক (আ.)এর ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৮ হিজরিতে। তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন নাজমা। ১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)এর শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)। এই মহান ইমামের শাহাদাত-বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি, বিশেষভাবে ইমাম রেজা (আ.)এর প্রতি পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ।
শেখ সাদুক (র) ইমাম রেজা (আ.) সম্পর্কে লিখেছেন, অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্ট, সাদিক বা সত্যবাদী, ফাজেল বা গুণধর, মু’মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো ও কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উৎস প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তবে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.)’র একটি বড় উপাধি হল ‘আলেমে আ’লে মুহাম্মাদ’ বা মুহাম্মাদ (সা.)’র আহলে বাইতের আলেম।
ইমাম রেজার পিতা ইমাম মুসা কাজিম বলেছেন, আমার বাবা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাকে বার বার বলতেন যে, আলে মুহাম্মাদের আলেম বা জ্ঞানী হবে তোমার বংশধর। আহা! আমি যদি তাঁকে দেখতে পেতাম! তাঁর নামও হবে আমিরুল মু’মিনিনের নাম তথা আলী।
প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত ‘শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত’ নামক বইয়ের একটি হাদিস অনুযায়ী, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)’র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও হয়েছে অনূদিত (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.’র ছোট বোন। মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারার একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
হিজরি প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইসলামি খেলাফত যখন সুস্পষ্টভাবেই জোর- জুলুমপূর্ণ বাদশাহিতে রূপান্তরিত হয়, তখন থেকেই আহলে বাইতের সদস্য সম্মানিত ইমামরা সময়োপযোগী পদ্ধতিতে সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এর লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন। কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের সব ধরনের চরম নিপীড়নের মুখেও তাঁরা নেতৃত্বের এই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের শাহাদাতের পবিত্র রক্ত জন্ম দিয়েছে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের লক্ষ-কোটি অনুসারী।
ইমাম রেজার ইমামতির বিশ বছর ছিল আব্বাসীয় তিন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন ও মামুনের শাসনকাল। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাজিম ( আ.)’র নীতি-আদর্শকে অব্যাহত রাখেন। ফলে পিতার মত তিনিও ক্ষমতাসীন মহলের রোষের মুখে পড়েন। আব্বাসীয় রাজবংশে বাদশাহ হারূন ও মামুনই ছিল সবচেয়ে প্রতাপশালী। তারা প্রকাশ্যে ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বলে বেড়ালেও ভেতরে ভেতরে ইমামদের রক্তের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত ছিলেন। ইমামদের প্রতি তাঁদের এ ধরনের আচরণের উদ্দেশ্য ছিল নবীবংশ প্রেমিকদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং শিয়া মুসলমানদের মন জয় করা। কারণ, মুসলমানরা যদি দেখে যে, বিশ্বনবী (সা.)’র নিষ্পাপ বংশধরদের প্রতি বাদশাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে তারা আব্বাসীয়দের শাসনকে বৈধ মনে করে এর বিরোধিতা করবে না।
তাই ইমাম রেজা (আ.) এই সত্য তুলে ধরেন যে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কেবল নবী পরিবারের নিষ্পাপ ইমামরা এবং তাঁরা ছাড়া কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়। জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে তারা বাদশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে-এই আশঙ্কায় ধূর্ত মামুন ইমাম রেজাকে (আ) জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। কেবল ইমাম রেজা (আ.) নন প্রায় সব ইমামই উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। কিন্তু নিষ্পাপ ইমামদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়। ফলে জনগণ নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে।
বাদশাহ মামুনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেজা (আ.) যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন ইরাকের অধিকাংশ জনগণ মামুনের বিরোধী হয়ে পড়ে। হযরত আলী(আ.)’র পবিত্র খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহি হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। ফলে মামুন একটা আপোষ-নীতির কৌশল গ্রহণ করে ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম রেজা প্রথমত মামুনের প্রস্তাবে রাজি হননি, কিন্তু পরবর্তীকালে খোরাসানে আসার বাদশাহী আমন্ত্রণ গ্রহণে বাধ্য হন । তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে পথিমধ্যে গতিপথ বদলে ইরানের দিকে রওনা হন। নবীবংশের মধ্যে ইমাম রেজাই প্রথম ইরান সফর করেন। যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্বর্ধনা দেয়। ইমামও নবী করিম (সা.), তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান।
ইমাম ইরানের নিশাপুরে এক বিশাল জনসমাবেশে একটি বিশেষ হাদিস উল্লেখ করেছিলেন। আব্বাসিয় বাদশাহ মামুনের প্রাসাদের দিকে যাওয়ার প্রাক্কালে জনগণের অনুরোধে বলা ওই হাদিস তাঁর থেকে সরাসরি শুনে লিপিবদ্ধ করেন বিপুল সংখ্যক আলেম ও হাদিস বিশারদ। বলা হয় শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বিশ হাজারেরও বেশি আলেম এই হাদিস সেদিন সেখানেই লিপিবদ্ধ করেন।
সিলসিলাতুল যাহাব বা স্বর্ণালী চক্র নামে খ্যাত ওই হাদিসে ইমাম রেজা (আ) ওই হাদিস উল্লেখ করে বলেন, মহানবী (সা) বলেছিলেন, মহান ফেরেশতা জিবরাইল (আ) বলেছেন তিনি গৌরবময় মহান আল্লাহকে বলতে শুনেছেন যে তিনি বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ বা উপাস্য নেই- এই বাক্যটি হচ্ছে আমার দুর্গ, তাই যে তাতে প্রবেশ করবে সে আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে। এতটুকু বলার পর ইমামের কাফেলার যানবাহন চলা শুরু করলে তিনি আরও বলেন, অবশ্য এর তথা মহান আল্লাহর ওই ঘোষণার শর্তাবলী রয়েছে এবং আমি হচ্ছি এর অন্যতম শর্ত! অর্থাৎ তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর ইমামত আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনোনীত। আর তাই তাঁর আনুগত্য করা ফরজ।
ধূর্ত বাদশাহ মামুন ইমাম রেজার আগমনের পর তার সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেন, হে লোকেরা ! আমি আব্বাস ও আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা বিন রেজার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে, খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করবো। ইমাম রেজা মামুনের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন, তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করে। ইমাম রেজা (আ.) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। শর্তগুলোর আলোকে ঠিক হয় যে ইমাম প্রশাসনের কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না ও কাউকে নিয়োগ দান বা পদচ্যুত করবেন না, কেবল দূর থেকে খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন। মামুন ইমাম রেজার নামে বিশেষ মুদ্রাও চালু করেছিল।
মামুনে প্রকাশ্যে বা সামনাসামনি ইমামকে খুব শ্রদ্ধা করলেও ভেতরে ভেতরে তার অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তৎপর ছিল। এরই আলোকে আব্বাসীয়রা ইমাম রেজাকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। যেমন, বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম রেজাকে জব্দ করার চেষ্টা, কিংবা ক্ষরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টি বর্ষণের জন্য ইমামকে দিয়ে এই আশায় দোয়া করানো যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা বিলীন হবে। কিন্তু আসমানি জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ এবং মহান আল্লাহর মনোনীত ইমামকে তাঁরা কিছুতেই অপমান করতে পারেনি। ইমাম রেজা (আ) প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল।
বাদশাহ মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রেক্ষাপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশাহ ভীষণ ক্ষেপে যান এবং ইমাম সম্পর্কে ভীষণ বিদ্বেষ লালন করতে থাকেন। ইমাম রেজার ইমামত, জনপ্রিয়তা, খেলাফত ও আলীর বংশধর হওয়াসহ নানা দিক বাদশাহ’র মনে হিংসা ও শত্রুতার আগুন বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে জনগণ বুঝতে পারে যে, খেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি যোগ্য। ফলে ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে।
ইমাম রেজা (আ) মামুনের মোকাবেলায় নির্ভীকচিত্তে সত্য তুলে ধরছিলেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে অপমান করা গেল না, তখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে ডালিমের রস বা আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়-জ্বালা মেটাবার উদ্যোগ নেয়। ২০৩ হিজরির ৩০ সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে অমর হয়ে গেলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের শাহাদাত বার্ষিকীতে ও জন্মদিনে লাখ-লাখ মানুষ আসে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। যুগ যুগ ধরে মানুষের নেক-বাসনা পূরণের উসিলা হিসেবে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি রয়েছে নবীবংশের ইমামদের। ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর পবিত্র মাজারও এর ব্যতিক্রম নয়।
ইমাম রেজা অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে সবার জন্য সর্বোত্তম ও বোধগম্যভাবে ইসলামের বিশ্বাসগুলো তুলে ধরেছিলেন। আর তিনি এত গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী এবং সেসবের প্রচারক ও বিকাশক ছিলেন বলেই তাঁকে ‘আলেমে আলে মুহাম্মাদ’ তথা মহানবীর আহলে বাইতের আলেম শীর্ষক উপাধি দেয়া হয়েছিল।
ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন, “জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত সম্পদের মত যার চাবি হল, প্রশ্ন। আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক, কারণ প্রশ্নের মাধ্যমে চার গ্রুপ তথা প্রশ্নকারী, শিক্ষার্থী, শ্রবণকারী ও প্রশ্নের উত্তর-দাতা সবাই-ই সাওয়াব বা পুরস্কার লাভ করেন।